বর্তমান বিশ্ব হল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার বিশ্ব। জীবনের এমন কোন ক্ষেত্র নেই, যেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার করে থাকি না আমরা। আর বর্তমানের এই প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতির প্রধান নিদর্শন হলো রোবোটিক্স (Robotics) বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI Robotics). অফিস, বাড়ি, শিক্ষাক্ষেত্র, চিকিৎসার ক্ষেত্র থেকে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র সকল স্থানেই বিভিন্ন কাজে এই রোবটিক্স বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর ব্যবহার দেখা যায়।
যেমন একটি ছোটো উদাহরণ হল আজকাল আমরা অনেকেই ঘরে টিভি, পাখা, আলো ইত্যাদি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা রোবোটিক্সের সাহায্য নিই। কিন্তু এই রোবটিক্স সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য এবং এর ব্যবহার জানলেও এর সর্বোচ্চ ক্ষমতা সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত আমাদের অনেকেরই ঠিক মতো জানা নেই। কতটা শক্তিশালী হতে পারে এই রোবটিক্স বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবস্থা, জানলে অবাক হবেন আপনিও। তবে চলুন জেনে নেওয়া যাক।
রোবটিক্স কি?
রোবট হল (Robot) একটি যন্ত্র মানব। এর মধ্যে পূর্ব থেকে কিছু কম্পিউটার ভিত্তিক প্রোগ্রাম তৈরি করে তা লোড করে রাখা হয়। বিভিন্ন কোডের মাধ্যমে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়াররা তৈরি করেন সেই প্রোগ্রামগুলি। পরবর্তীকালে এর ওপর ভিত্তি করেই কাজ করে সেই রোবট। তাকে যা কমান্ড করা হবে অর্থাৎ যে কাজ করতে বলা হবে তার ডেটা যদি এর সিস্টেমে প্রিলোডেড থাকে তাহলে সেই কাজ অনায়াসেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে করে ফেলতে পারে এই রোবট। আর বিজ্ঞানের যে শাখায় রোবট তৈরি, তার বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ, ব্যবহার ও প্রয়োগ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা করা হয় তাকেই বলা হয় রোবটিক্স।
কি করে উৎপত্তি হলো এই রোবটিক্সের?
রোবটিক্স (Robotics) কোন আধুনিক ধারণা নয়। অতি প্রাচীন কাল বলা ভালো যীশু খ্রীষ্টের জন্মের আগে থেকেই চর্চা শুরু হয় এই ক্ষেত্র নিয়ে। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ শতাব্দীতে গ্রিক গণিতবিদ আর্কিটাস সর্বপ্রথম একটি যান্ত্রিক পাখি তৈরি করেন যার নাম তিনি দেন, ‘The Pigeon ‘. এরপর কম্পিউটারের যুগ আসার পর জর্জ ডেভেল নামের এক বিজ্ঞানী কম্পিউটার প্রোগ্রামকে কাজে লাগিয়ে এক রোবট তৈরি করেন যার নাম তিনি দেন ‘Unimate’. বিশ্বের প্রথম রোবট ছিল এটি। এর প্রধান কাজ ছিল জিনিসপত্র ওঠানামা করাতে সাহায্য করা।
তার পরবর্তীকালে ১৯৬৬ সালে স্টান্ডফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে তৈরি হয় প্রথম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবট। এর নাম ছিল ‘Shakey Robot ‘. এর কাজ ছিল কোন ধাঁধা বা প্রতিবন্ধকতাকে সনাক্ত করা এবং তা অতিক্রমে সাহায্য করা। তারপর চলতি শতাব্দীর গত ২০১৭ সালে সৌদি আরব তৈরি করে বিশ্বের প্রথম মানুষের চেহারার ন্যায় রোবট যার নাম ছিল ‘Sophia’. এইভাবেই ক্রমশ বিবর্তিত হয়ে আসছে রোবোটিক্সের (Robotics) পৃথিবী।
Types of Robotics
রোবট কত ধরনের?
রোবটের চেহারা অথবা তার ব্যবহারের ক্ষেত্র বিবেচনা করে রোবটের বিভিন্ন শ্রেণির নাম নির্ধারণ করা হয়। সেই অনুযায়ী রোবটের বিশেষ কিছু উল্লেখযোগ্য ধরণ সম্পর্কে নিজে আলোচনা করা হলো।
1. Autonomous Mobile Robotics:
এই ধরনের রোবট গুলি একটানা ক্রমাগত কাজ করে যেতে পারে। সে যত ছোট বা যত বড় কাজই হোক না কেন। সেই কারণে এই রোবটগুলিকে বিভিন্ন কারখানা বা শিল্পাঞ্চলে বিভিন্ন ভারী কাজ করাতে ব্যবহার করা হয়। যেমন জিনিসপত্র বহন করা, প্যাকিং, ড্রিলিং, বক্স বাঁধা ইত্যাদি কাজে এই ধরনের রোবটের প্রয়োগ দেখা যায়।
2. Automatic guided vehicle:
এই রোবট গুলি অনেকটা আগের ধরনের রোবট গুলোর মতই কাজ করে। তবে শুধু তফাৎ হচ্ছে এই ধরনের রোবটের ক্ষেত্রে কোন রেডিও ওয়েভ, মাইক্রোওয়েভ অথবা লেজার লাইট দ্বারা নির্দিষ্ট করা পথেই এটি চলাচল করতে পারে। এগুলি অনেকটা যানবাহনের মত কাজ করে। সেই কারণেই এগুলোকে এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। তবে সমতল জায়গাতেই এটি চলাচলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হয়। সে কারণে বিভিন্ন শিল্প কারখানায় জিনিসপত্র এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ির মতো এই রোবট ব্যবহার করা হয়।
3. Articulated robot:
এই ধরনের রোবট গুলি দেখতে অনেকটা মানুষের হাত অথবা পা এর মত হয়। মানুষের হাতপায়ে যেমন বিভিন্ন হাড়ের জয়েন্ট থাকে তেমনি ভাবে এই রোবট গুলিতেও বিভিন্ন জয়েন্ট থাকে যার মাধ্যমে এগুলি সব দিকে চালিত হতে পারে। সেই কারণেই এটি অনেকটা মানুষের মতো করে কাজ করে। বড় বড় ফ্যাক্টরি গুলিতে জিনিসপত্র তোলা নামা করা অথবা অন্যান্য সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ এর দ্বারা করানো হয়ে থাকে।
4. Humanoid Robotics:
এই রোবট গুলি দেখতে পুরোপুরি মানুষের মতো। আর মানুষের চেহারার সঙ্গে অবিকল মিল থাকার কারণেই এগুলির নামকরণ এরকম করা হয়েছে। এগুলি কাজ করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর ওপর ভিত্তি করে। যেকোনো ধরনের জিনিস লেখা, পড়া, শোনা, দেখা, বলা ইত্যাদি কাজ এই ধরনের রোবট করে থাকে। বর্তমানে স্মার্টফোন অথবা কম্পিউটার এছাড়াও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক গেজেটে এই ধরনের রোবটিক্স এর ব্যবহার দেখা যায়।
5. Hybrid robot Robotics:
হাইব্রিড রোবট কোন বিশেষ ধরনের একটি রোবট নয়। প্রধানত দুই বা ততোধিক শ্রেণীর রোবটকে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত করে এই ধরনের রোবট তৈরি করা হয়। যেমন মনে করুন একটি Autonomous robot এবং Articulated robot একসঙ্গে সংযুক্ত করা হল। তাহলে দু ধরনের রোবটের কাজ এই এক ধরনের রোবটের দ্বারা করা সম্ভব হবে। ফলে এর কাজের গতি প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে।
আরও পড়ুন, পনেরো হাজার টাকার মধ্যে সেরা 5G স্মার্ট ফোনের তালিকা, ফিচার্স, কাস্টোমার রিভিউ ও দাম দেখুন।
6. Co-bot:
Collaboration এবং robot এই কথা দুটিকে একত্রিত করে তৈরি করা হয়েছে এই প্রকারের রোবটের নাম। এই ধরনের রোবট মানুষের সঙ্গে কোলাবরেশন করে অর্থাৎ একসঙ্গে কাজ করে। এগুলির কাজের গতি অত্যন্ত কম এবং আকারে ছোট হয়।
রোবটের প্রয়োগ কোন কোন ক্ষেত্রে করা হয়?
- ঘরোয়া কাজে মানুষের ভার্চুয়াল সহযোগী হিসেবে।
- শিক্ষা, বিনোদনের এবং সামরিক ক্ষেত্রে।
- অতি ক্ষুদ্র জিনিস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ক্ষেত্রে, খানিকটা মাইক্রোস্কোপ হিসেবে।
- মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে।
- চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিভিন্ন জটিল অপারেশন সাড়ার ক্ষেত্রে অথবা বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে।
রোবট ব্যবহারের সুবিধা:
- মানুষকে অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয়। দূর্ঘটনাবশত অনেকের প্রাণও চলে যায়। যে সকল জায়গাতে বিপদের ভ্রূকুটি রয়েছে সেখানে রোবটগুলিকে কাজে লাগালে বিপদের সম্ভাবনা আর থাকবে না। কোনোরকম দুর্ঘটনা ঘটলেও মানুষের ক্ষতি হবার সুযোগ থাকে না।
- রোবটকে কাজে লাগিয়ে প্রোডাকশনের স্পিড অনেকাংশে বাড়ানো যায়। রোবটের না টিফিনের দরকার পড়ে, না দরকার পড়ে কোনো ছুটির। তারা কখনোই ক্লান্ত হয়ে পড়ে না। তাদের কাজের গতি কখনোই কমে আসবে না।
- রোবোটের (Robotics) কাজে কখনোই মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে না। কেউই তাদের অ্যাটেনশন কেড়ে নিতে পারবে না। তারা অবিরত কাজ করে যেতে পারে। তাদের বিশ্রামের প্রয়োজন পড়ে না। তারা কখনোই কাজে ফাঁকি মারে না । তারা তাদের কাজে সর্বদা অবিচল থাকে।
- পারফেক্ট প্রোডাকশন দেওয়ার জন্য রোবটের সুনাম রয়েছে। এত ভালো কোয়ালিটি বের করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। রোবটগুলি (Robotics) সাধারণত কখনো ভুল করে না। তারা নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম মতো নির্দিষ্ট কাজ করে যেতেই থাকে। একটুও অন্যথা হয় না।
রোবটের অসুবিধা:
- রোবট দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে। সবজায়গায় রোবটের (Robotics) সংখ্যা বাড়লে মানুষ চাকরী হারাবে। ফলে অনেক মানুষ কর্মচ্যুত বা বেকার হয়ে পড়বে। ফলে নতুন করে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেবে।
- রোবটের ভিন্ন সত্তা বা বুদ্ধিমত্তা বলতে কিছু নেই। তারা ততটুকুই কাজ করতে পারে যতটুকু নির্দিষ্ট করে দেওয়া থাকে। প্রোগ্রামের বাইরে তাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই। তাই রোবট কখনোই মানুষের বিকল্প হতে পারে না।
- বিশাল সংখ্যক মানুষের বিকল্প হিসেবে রোবট প্রতিস্থাপন করা কিন্ত মোটেই কম খরচের ব্যাপার নয়। তাদের প্রাথমিক খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ সবকিছুতেই যথেষ্ট খরচ জোগাতে হয় যা সাধারণ মানুষের ধরাছোয়ার বাইরে।
- রোবটকে দিয়ে সারাক্ষণ কাজ করানো যায়- একথা যেমন সত্য। ঠিক তেমনি এর নেতিবাচক দিকও রয়েছে। রোবট (Robotics) চালাতে গেলে সর্বক্ষণের ইলেকট্রিক পাওয়ারের প্রয়োজন পড়বে যা শেষমেশ পরিবেশ দূষণে পর্যবসিত হয়
- একটা মানুষ বিভিন্ন প্রকারের কাজ করার ক্ষমতা রাখে, কিন্তু এক একটা রোবট শুধুমাত্র একটা বা কয়েকটা নির্দিষ্ট কাজ করতেই সক্ষম। অন্য কাজ তারা করে উঠতে পারবে না। একটা মিলিটারী রোবট (Robotics) কখনোই মেডিক্যালে কাজ করতে পারবে না। তাই মনে রাখা দরকার যে রোবটের কাজের পরিসর খুবই সীমিত।
- রোবটের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেলে মানুষের টেকনোলজির উপর নির্ভরশীলতা অনেকাংশে বেড়ে যাবে। ফলে মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসবে। যন্ত্রের ঘেরাটোপে মানুষের অনুভূতিগুলি হারিয়ে যাবে।